অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কক্সবাজার
মৎস্য শিল্পঃ
কক্সবাজার জেলায় গ্রামীন কৃষিজীবি পরিবারের ১৮ শতাংশ ট্রলার অথবা নৌকায় করে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। এখানে আহরিত মাছ সারাদেশে সরবরাহের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানী করা হয়ে থাকে। অনেকে জীবিকার তাগিদে সাগর তীরে চিংড়ী মাছের পোনা ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। অর্থনৈতিক গুরত্ব সম্পন্ন স্বাদু ও নোনা জলের মৎস্য প্রজাতি সমূহ এ অঞ্চলে পাওয়া যায়। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে কুতুবদিয়া ও মহেশখালীর চ্যানেলে মৎস্য প্রজাতির লালন, প্রজনন ও বিচরণ এলাকা। উল্লেখ্য যে, উক্ত এলাকার লবণাক্ত পানি মৎস্য চাষের জন্য উপযোগী। এ জেলার সাগর,মোহনা, খাল, নদী, বিল, খাঁড়ি থেকে ধান চাষের সময় এবং বর্ষাকালে প্রচুর মাছ ধরা হয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৎস্য চাষের মাধ্যমে দেশীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থান সম্ভব।
চিংড়ি শিল্পঃ
কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলীয় জমিতে ব্যাপক ভিত্তিতে চিংড়ি চাষ হয়। এখানকার উৎপাদিত বাগদা ও গলদা চিংড়ি স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এই উদ্দেশ্যে স্থানীয় ভাবে গড়ে উঠেছে চিংড়ি পোনা উৎপাদন শিল্প (হ্যাচারী) ও চিংড়িজাত খাবার তৈরী শিল্প। এই শিল্পের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
লবন শিল্পঃ
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে যতদূর জানা যায় পঞ্চদশ শতাব্দীতে কক্সবাজার জেলায় লবণ চাষ শুরু হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সহায়তায় এখানে বাণিজ্যিকভাবে লবণ ব্যবসা বিকাশ লাভ করলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজ সরকার এদেশে লবন উৎপাদন নিষিদ্ধ করে ইংল্যান্ড থেকে লবণ আমদানি শুরু করে। এরপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে উপকূলীয় জমি পরিষ্কার করে সাগরের পানি সূর্যেও তাপে বাস্পীভবনের মাধ্যমে জনৈক ব্যক্তি নতুন করে লবণ চাষ শুরু করেন। উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৪৭ সালে কক্সবাজার সদর উপজেলার গোমাতলী মৌজাতে এক ব্যক্তি ১২০ একর জমি দীর্ঘ মেয়াদী বন্দোবস্ত নিয়ে লবণ চাষ শুরু করেছিলেন। সে থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লবন উৎপাদনের যাত্রা শুরু হয়। লবণ চাষীরা সাধারণত দরিদ্র এবং অন্যের কাছ থেকে জমি নিয়ে লবণ চাষ করে। লবণ চাষীদের অধিকাংশ সাগরের তীরে কাছাকাছি এলাকায় বাস করে। এবং তাদেরকে প্রতিনিয়তই বৈরী প্রাকৃতিক পরিবেশ মোকাবিলা করতে হয়। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী কক্সবাজার জেলায় ৬৩,৫৩২ একর লবণ মাঠ রয়েছে। এই লবণ মাঠগুলো থেকে ২০০৪-২০০৫ সালে মোট ৯,৩৫,০০০ মেঃ টন লবণ উৎপাদিত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, কক্সবাজার জেলার লবণ চাষীর সংখ্যা ৪৩ হাজার ৫০০ জন। লবণের গুণগত মান উন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিসিক পলিথিন পদ্ধতিতে লবন উৎপাদন শুরু করেছে। এই পদ্ধতিতে সনাতন পদ্ধতির তুলনায় ৩০% বেশী ও ধবধবে সাদা মান সম্মত লবণ উৎপাদিত হয়।
শুটকি শিল্পঃ
বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য চাষের পাশাপাশি জেলার মূল ভূখন্ড ও দ্বীপাঞ্চলে প্রচুর পরিমানে শুটকি তৈরী করা হয়। এর মধ্যে কক্সবাজার সদর উপজেলা, সোনাদিয়া, মহেশখালী ও সেন্টমার্টিন অন্যতম। শুকনো মৌসুমে জেলেরা মাছের জাত বিচারেও শুটকি তৈরীর উঠোন,জেটি সংলগ্ন এলাকায় মাটির উপর বা পাটি বিছিয়ে বা বাঁশের মাচায় রোদে দেয়। এই পদ্ধতিতে শুটকি মাছ পোকামাকড়ে আক্রান্ত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এখানে সোলার টানেল ড্রায়ার পদ্ধতিতে শুটকি তৈরী শুরু হয়েছে। এ সকল শুটকি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি করে বাংলাদেশ মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। উল্লেখযোগ্য যে, বঙ্গোপসাগরের আহরিত মাছের ২৫-৩০ শতাংশ শুটকিতে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। আহরিত মৎস্যজাত দ্রব্য যথাঃ সার্ক ফীন, ফীস লিভার অয়েল, এয়ার বস্নাডার ইত্যাদি শুকিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়।
হস্ত শিল্প
ঐতিহ্যগতভাবে কক্সবাজার হস্তশিল্প সমৃদ্ধ।আরাকান বংশোদ্ভূত রাখাইনরা নানাবিধ হস্তশিল্পে নিয়োজিত।এদের তৈরী বিভিন্ন রকমের কাপড়, তৈরী পোষাক, তোয়ালে, ব্যাগ ইত্যাদি দেশে ও বিদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।এ ছাড়া রাখাইনদের উৎপাদিত কাষ্ঠ নিমির্ত নর-নারী ও পশুপাখির নানা রকম ভাস্কয্য, ঝিনুক ও শংখজাত সামগ্রীর বিশেষ চাহিদা রয়েছে।
কাকড়া
রপ্তানীযোগ্য মৎস্যজাত পণ্যের ক্ষেত্রে চিংড়ির পরে কাকড়া দ্বিতীয় স্থানে আছে।কাকড়া আহরণ ও বিক্রির মধ্যবর্তী পর্যায়ে কাকড়া মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি জেলার কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতির উন্নয়নে বিপুল সম্ভাবনার সূচনা করেছে।
পর্যটন শিল্প
সৈকত নন্দিনী কক্সবাজার জেলা বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা।প্রতি বছর এ জেলায় দেশী-বিদেশী অসংখ্য পর্যটক আগমন করেন।এখানে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম বালুকাময় সাগর সৈকতসহ নানারূপ দর্শনীয় ও প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন।পর্যটকদের সুবিধা বৃদ্ধির স্বার্থে সী-বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি গত প্রায় ৩ বছর যাবৎ নিয়মিত ভাবে বিভিন্ন অবকাঠামোগত সুবিধা প্রদান করেছে।পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে পাঁচ তারকা বিশিষ্ট হোটেলসহ শতাধিক মোটেল স্থাপিত হয়েছে।এ জেলায় পর্যটন শিল্পের বিকাশের ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
খনিজ সম্পদ
১২০ কিঃমিঃ দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতের বালিতে প্রায় ৮ ধরণের Heavy Mineralপাওয়া সম্ভব।বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৭টি জায়গায় এই Heavy Mineralএর সন্ধান পাওয়া যায়।তন্মধ্যে কক্সবাজার সৈকত, মহেশখালী, টেকনাফ, ইনানী, বদর মোকাম, মাতারবাড়ী অন্যতম।উল্রেখ্য যে, কক্সবাজার জেলায় ১৯৬১ সালে খনিজ বালুর সন্ধান কাজ শুরু হয়।পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালের দেশীয় ও অস্ট্রেলীয় ভূতত্ত্ববিদের একটি দল প্রায় এক দশক যাবৎ গবেষণা করে দেখেন যে, কক্সবাজারের প্রায় ১১৫৯ বর্গ কিঃমিঃ এলাকা জুড়ে রয়েছে জিরকন, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, কয়নাইট, মোনাজাইট এর মত মূল্যবান খনিজ পদার্থ ।এসব খনিজ পদার্থ প্রক্রিয়াজাত করা গেলেো তা দেশের খনিজ সম্পদ বিকাশের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
বনজ সম্পদ
কক্সবাজার জেলার প্রধান বনাঞ্চলগুলো হলো ফুলছড়ি রেঞ্জ, ডুমুরিয়াঘোনা রেঞ্জ, মেহেরঘোনা রেঞ্জ, বাকখালী রেঞ্জ ইত্যাদি।এ ছাড়া ইনানী, রামু, উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায়া বনাঞ্চল আছে।এ সকল বনভুমিতে উৎপাদিত প্রধান প্রধান বৃক্ষ হলো সেগুন, মেহগণি, চাপালিশ, কেওড়া, বাইন ইত্যাদি।চকরিয়া অঞ্চলের সুন্দরবনে প্রচুর পরিমানে বাঁশ, বেত, মধু, মোম উৎপাদন সম্ভব।একই ভাবে রামুর রাবার বাগান সংরক্ষনের মাধ্যমে দেশের রাবার শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।এছাড়া কুতুবদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপের উপকূলীয় বনভূমি রক্ষার মাধ্যমে জ্বালানী, ঘর তৈরীর উপকরণ বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধ ও উপকূলীয় বাঁধ রক্ষার পাশাপাশি মৎসচারণ লালন এবং প্রজনন স্থান সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।
পান ও সুপারী
কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মিঠাপান সুপ্রসিদ্ধ।জেলার প্রায় সকল উপজেলায়ই পান ও সুপারী চাষ হচ্ছে।পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমুহে এই মিঠা পানের যথেষ্ঠ কদর রয়েছে।এই পান সুপরিকল্পিতভাবে চাষ করে উৎপাদন বৃদ্ধি ও আধুনিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানীর মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃস্টির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
বিদেশে কর্মসংস্থান
কক্সবাজার জেলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নানাবিধ কার্যোপলক্ষ্যে অবস্থান করছে।এতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস